ঢাকা,বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪

কক্সবাজারে শুরুর আগেই বন্ধ ৩ কোটি টাকার কাঁকড়া হ্যাচারি

আহমদ গিয়াস, কক্সবাজার ::  কক্সবাজার শহরতলীর কলাতলী সাগর তীরে ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত দেশের একমাত্র কাঁকড়া পোনা উৎপাদনকারী সরকারি হ্যাচারিটি উৎপাদন শুরুর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। চলতি বছরের ১৪ জুন এটি উদ্বোধন হয়। এর পক্ষকাল পরই ৩০ জুন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর থেকেই গত প্রায় চার মাস ধরে কার্যত পরিত্যক্ত এ হ্যাচারিটি।

দেশে কাঁকড়া ও কুঁচিয়া চাষ সম্প্রসারণের জন্য পাঁচ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্পের অধীনে কক্সবাজারে দেশের প্রথম ও একমাত্র কাঁকড়া পোনার হ্যাচারিটি নির্মাণ করা হয়। গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি শহরতলীর কলাতলী সাগর তীরে অবস্থিত মৎস্য অধিদপ্তরের পিসিআর ল্যাব সংলগ্ন স্থানে হ্যাচারির নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ। চলতি বছরের ১৪ জুন হ্যাচারিটি উদ্বোধন করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রইসউল আলম মন্ডল। কিন্তু হ্যাচারিটি উদ্বোধনের আগেই গত মে মাসে প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক (পরামর্শক) ফিলিপাইনের নাগরিক মিজ এমিলি নিজ দেশে ফিরে যান। এরপর তিনি আর বাংলাদেশে আসেননি। জুনে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হলেও মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। ইতোমধ্যে এ হ্যাচারিতে চুক্তিভিত্তিতে নিয়োজিত বিদেশি পরামর্শকসহ অন্যদের চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। ফলে উৎপাদন শুরুর আগেই বন্ধ হয়ে গেল কাঁকড়া পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারিটি।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এএসএম খালেকুজ্জামান বলেন, পাঁচ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্পের অধীনে প্রকল্পের প্রায় শেষ পর্যায়ে কাঁকড়া পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারিটি উদ্বোধন হয়েছে। তবে ওই সময়টি আসলে পোনা উৎপাদন মৌসুম ছিল না। কাঁকড়া পোনা উৎপাদন করা যায় নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পাঁচ মাস। এখন হ্যাচারিটি চালুর জন্য রাজস্ব খাত থেকে মৎস্য অধিদপ্তর যদি বরাদ্দ দেয় তাহলে ফের চালু করা যাবে।

প্রায় তিন কোটি বিশ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত কাঁকড়া পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারিতে প্রতি সাইকেলে বা ২৮ দিন অন্তর ৯০ হাজার করে পোনা উৎপাদন করার কথা ছিল। এ কাজে প্রতি মাসে প্রায় ৬ লাখ টাকা বেতনে ফিলিপাইনি পরামর্শক মিজ এমিলিকে আনা হয়েছিল। এ প্রকল্পে রাজস্ব খাত থেকে কোনো বরাদ্দ ছিল না বলে প্রেষণে মৎস্য অধিদপ্তর থেকে লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। প্রকল্পটির মেয়াদ উত্তীর্ণের পর মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মচারীদের ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

ভাইরাসসহ নানা রোগব্যাধির কারণে বিপর্যস্ত দেশের চিংড়ি শিল্পের বিকল্প হিসাবে ভাবা হচ্ছিল নরম খোলসের কাঁকড়া চাষকে। কক্সবাজারসহ দেশের উপকূলীয় জলাভূমি বা ঘেরে উৎপাদিত নরম খোলসের কাঁকড়া বিশ্বের অন্তত ২০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এর মধ্যে ভিয়েতনাম, জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে কক্সবাজারের কাঁকড়ার সুখ্যাতি। ফলে চিংড়ি চাষিরা ঝুঁকিমুক্ত এ চাষের দিকে ঝুঁকছে। এতে করে নতুন এ খাত থেকে বিপুল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পাশাপাশি বেকারদের জন্যও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। বিদেশে কাঁকড়ার চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে এখন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে করা হচ্ছে কাঁকড়ার চাষ। ফলে কাঁকড়ার উৎপাদন যেমন বাড়ছে, তেমনি চাষিরাও লাভবান হচ্ছেন। উন্নতি পদ্ধতিতে কাঁকড়া উৎপাদনের কারণে বিদেশে বাংলাদেশের কাঁকড়ার চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতোমধ্যে কাঁকড়া চাষ ও রপ্তানি করে জাতীয় মৎস্য পুরস্কার-২০১৬-এ স্বর্ণপদক ও ৫০ হাজার টাকার পুরস্কার জিতে নিয়েছেন কক্সবাজারের কাঁকড়া চাষি অংছিন। তবে কাঁকড়ার চাষ জনপ্রিয় হলেও প্রাকৃতিক উৎস থেকে পর্যাপ্ত পোনা পাওয়া সম্ভব না হওয়ায় দেশে কাঁকড়া চাষের কাক্সিক্ষত বিস্তৃতি ঘটছে না বলে জানান অংছিন। তিনি জানান, কৃত্রিম উপায়ে হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদনে এখনো কাক্সিক্ষত সাফল্য আসেনি। একটি কাঁকড়া ৬০ লাখ থেকে ১ কোটি ডিম দিলেও এখনো শতকরা ১ ভাগও বাঁচিয়ে রাখা যাচ্ছে না।

হ্যাচারিতে কৃত্রিম উপায়ে প্রথম কাঁকড়া পোনা উৎপাদনে সক্ষম হন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। ২০১১ সালে কক্সবাজার সামুদ্রিক মৎস্য গবেষণা ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের তৎকালীন প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এনামুল হকের তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক সাফল্য এলেও গত ৮ বছরেও এ নিয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আসেনি।

এ বিষয়ে বিজ্ঞানীদের আরো নিবিড় ও ধারাবাহিক গবেষণার ওপর জোর দেন কাঁকড়া ও কুঁচিয়া চাষ প্রকল্পের তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) ড. বিনয় কুমার চক্রবর্তী। তিনি বলেন, বিদেশে রপ্তানির প্রেক্ষিতে সমুদ্র উপকূলীয় জেলাগুলোতে কাঁকড়া চাষ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই কাঁকড়া পোনার চাহিদা মেটাতে অবশ্যই কৃত্রিম উপায়ে পোনা উৎপাদনে সাফল্য পেতে হবে।

261

পাঠকের মতামত: